অনলাইন ডেস্ক:
দারুণ এক মুহূর্ত। তাতে আছে মাদার ফুলের মধ্যে তিন কাঠশালিকের খুনসুটি। এটি যেনতেন কোনো ছবি নয়! লাখ ছবির মধ্যে বেছে বেছে এটিকে সেরা মেনে রায় দিয়েছেন আলোকচিত্রের আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা ‘উইকি লাভস আর্থ ২০২০’,–এর বিচারকেরা। জমা পড়া ১ লাখ ৬ হাজার ছবির মধ্যে এটি অর্জন করেছে প্রথম স্থান। ছবিটি বাংলাদেশের, তুলেছেন বগুড়ার আলোকচিত্রী তৌহিদ পারভেজ। বিপ্লব নামেই তিনি বেশি পরিচিত। শখ থেকেই ছবি তোলেন বিপ্লব। আর সেই শখ তাঁকে টেনে নিয়ে গেছে বনে–বাদাড়ে, সমুদ্র কিংবা পাহাড়ে।

এক ছবির জন্য পাঁচ দিনে ২৫ বার!
কাঠশালিকের ছবি অনেকে তুলেছেন। কিন্তু বিপ্লব তুলতে চান ব্যতিক্রমী একটি ছবি। খোঁজ নিয়ে জানলেন হবিগঞ্জের সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানে মাদার গাছে ফুল ফুটলে সেই ফুলের মধু খেতে অনেক পাখি ভিড় করে। সেখানে ঝাঁকে ঝাঁকে কাঠশালিকও আসে। লেন্স, ক্যামেরা নিয়ে সাতছড়ি চলে গেলেন বিপ্লব। খুব ভোরে সূর্য ওঠার আগে ক্যামেরা তাক করে থাকলেন। বারবার ক্লিকেও মনের মতো ছবি পাচ্ছিলেন না বিপ্লব। কিন্তু তাঁর খ্যাপাটে স্বভাব সেরা ছবি না নিয়ে ফিরবেই না। বিপ্লব মুঠোফোনে বললেন, ‘ফেব্রুয়ারি মাস। শীতও পড়েছিল। পাঁচ দিনে ২৫ বার ভোরসহ বিভিন্ন সময়ে ক্যামেরা নিয়ে ঘুরলাম। সঙ্গে থাকা অনেকের কাছে এটা পাগলামি! তবে এটা আমার কাছে প্যাশন। ছবি তোলা শেষে ছবি বাছাই করতে গিয়ে একটি ছবি আমার মনের মধ্যে জায়গা করে নিল। ছবিটা ফেসবুকে দিলাম। যাঁরা পাখির ছবি তোলেন, তাঁদের অনেকে বলতে লাগলেন দারুণ মুহূর্তের ছবি পেয়েছি আমি।’

সেরাদের সেরা বিপ্লব
বিপ্লব জানালেন, উইকি লাভস আর্থ প্রতিযোগিতায় আরও কয়েকটি ছবি দেন তিনি। প্রথম পর্বে বাংলাদেশ থেকে এ প্রতিযোগিতায় ১০টি ছবির মধ্যে তিনটি ছবি জায়গা পেল বিপ্লবের। প্রথম, চতুর্থ, ষষ্ঠ স্থান অধিকার করল বিপ্লবের ছবি। অপেক্ষা করতে লাগলেন চূড়ান্ত ফলের জন্য। তবে ১৭ ডিসেম্বরের একটি ই–মেইল পেয়ে বিপ্লবের চোখ যেন বিশ্বাস করতে চাইল না! সারা বিশ্বের বাঘা বাঘা আলোকচিত্রী যে প্রতিযোগিতায় ছবি জমা দেন, সেখানে বিপ্লবের ছবিই সবার সেরা!
বিপ্লব বলেন, ‘অনেক প্রতিযোগিতায় সেরা ছবির পুরস্কার বা স্বীকৃতি পেয়েছি আমি। কিন্তু এটা একেবারেই অন্য রকম। লাখ ছবি থেকে এটি সেরা হয়েছে। বড় কথা হলো বাংলাদেশ বিশ্বের সেরা পুরস্কার পেয়েছে, এটাই বেশি গর্বের মনে হয়েছে।’
উইকি লাভস আর্থ ফটোগ্রাফি প্রতিযোগিতার অষ্টম আসর ছিল এ বছর। ৩৪টি দেশ এতে অংশ নেয়। মে থেকে জুলাই পর্যন্ত ১ লাখ ৬ হাজার ছবি জমা পড়ে। আগস্টে প্রতিটি দেশ থেকে শীর্ষ ১০ ছবি আন্তর্জাতিক বিচারকের কাছে পাঠানো হয়। সেখান থেকে সেরা হয় বিপ্লবের ছবি। পুরস্কার হিসেবে পাবেন এক হাজার ডলার। একই কাতারে রয়েছেন বিশ্বের স্বনামধন্য অন্য আলোকচিত্রীরা। দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছেন ইতালীয় আলোকচিত্রী লুকা ক্যাসেল (মাছরাঙার মাছ ধরার ছবি)। তৃতীয় স্থানেও বাংলাদেশ। বাংলাদেশের নাওয়াজ শরিফের তোলা জলার বন রাতারগুলের ছবি এই স্থানটি পায়। এ ছাড়া সপ্তম ও ১৫তম স্থানে রয়েছেন আরও দুজন বাংলাদেশি আলোকচিত্রী মেহেদি হাসান ও দীপু দত্ত।
বনে–বাদাড়ে কুমির সাপ
তৌহিদ পারভেজ পেশায় একজন ব্যবসায়ী। পড়াশোনা করেছেন নিউজিল্যান্ডের অকল্যান্ডে। পড়েছিলেন অকল্যান্ড ইনস্টিটিউট অব স্টাডিজে আন্তর্জাতিক ব্যবসায় বিষয়ে। তখনই ছবি তোলা শুরু করেন তিনি। ২০১৫ সালে দেশে আসেন। ছুটে বেড়ানো স্বভাবের কারণে খুলে বসেন বগুড়া ফটোগ্রাফি ক্লাব (বিপিসি)। ছবি তুলতে গিয়ে বুঝেছেন, এটাই তাঁর শখ। তবে বন্য প্রাণী বা পাখির ছবিই তাঁকে বেশি টানে। আর সে জন্যই প্রকৃতির টানে ছুটে বেড়ান লাউয়াছড়া, নাহয় সুন্দরবনের গহিনে কিংবা কোনো আকাশছোঁয়া পর্বতচূড়ায়।
ছবি তুলতে গিয়ে কখনো বন্য হাতির তাড়া খেয়েছেন, কখনো–বা গুইসাপ-কুমিরের সামনে পড়েছেন, আবার কখনো আটকা পড়েছেন পদ্মার চরে। কোনো কিছুই আটকাতে পারেনি খ্যাপাটে বিপ্লবকে। তিনি ছুটে বেড়িয়েছেন দেশের ৬১ জেলা এবং ২৯টি দেশের শতাধিক শহর। এ পর্যন্ত ৪০০ প্রজাতির বেশি দেশি পাখির ছবি সংগ্রহে আছে তাঁর।
ঝুলিতে যত পুরস্কার
আগেও আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছেন বিপ্লব। মস্কো ফটোগ্রাফি প্রতিযোগিতায় ব্রোঞ্জপদক, তুরস্কে ইন্টারন্যাশনাল ফটোগ্রাফি কনটেস্টে বিশেষ সম্মাননা এবং একবার ইন্টারন্যাশনাল ফটোগ্রাফি প্রতিযোগিতায় তৃতীয়, তুরস্কে ইব্রাহীম জামান ইন্টারন্যাশনাল ফটোগ্রাফি প্রতিযোগিতায় সম্মাননা, সার্বিয়ায় ইন্টারন্যাশনাল স্যালন রিফ্লেকশনে স্বর্ণপদক পেয়েছেন। বিপ্লবের তোলা ছবি যুক্তরাষ্ট্রের ফোর্বস, ইনসাইডার, অস্ট্রেলিয়ার ডাই প্রেস, মেক্সিকোর ইউনিভিশন, লন্ডনের ডেইলি মেইলসহ আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও প্রকাশিত হয়েছে।
বিদেশে পড়ে গরুর খামার
ছবি তোলার পাশাপাশি আরেকটি শখ ছিল বিপ্লবের—দেশ–বিদেশে গরুর খামারে ঘুরে বেড়ানো। বিশাল সব গাভি দেখে বিস্মিত হতেন। এগুলো কীভাবে লালন-পালন করা হয়, খামারিদের কাছ থেকে সে গল্প শুনতেন।
ঝোঁকটা তখন থেকেই মাথায় ঢোকে। দেশে ফিরে ২০১১ সালে সাতটি এঁড়ে বাছুর কিনে নিজেই একটি গরুর খামার দিয়ে বসেন। শুরুতে পরিবারের লোকজন বিষয়টিকে ভালোভাবে নেননি, কিন্তু তৌহিদ পারভেজ অন্য ধাতে গড়া। তাঁর খামারে এখন ফ্রিজিয়ান, শাহিওয়াল ও দেশি জাতের ৩৫টি গাভি ছাড়াও দেশি-বিদেশি জাতের এঁড়ে গরু ৫০টি। বাছুর ছয়টি। তিনি গড়ে তুলেছেন বগুড়া ভান্ডার ডেইরি অ্যান্ড অ্যাগ্রো ফার্ম লিমিটেড।